একটি ট্রাক ও ভালোবাসার গল্প

জীবন বহমান। দিন যায় সময় পেরোয় আর বয়স বাড়ে, আরো বাড়ে অভিজ্ঞতা। প্রতিদিনের ট্রাক লাগবের কার্যক্রমে আমাদের সাথে দেখা হয় অনেক ট্রাক মালিক, চালক কিংবা পণ্য প্রেরকের সাথে। ট্রিপের অবসরে আমরা মেতে উঠি  আড্ডায় । উঠে আসে জীবনের হাসি-আনন্দের যত গল্প। সেদিন চট্টগ্রাম বন্দরের একটি ট্রিপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা হয় মনসুর ভাইয়ের সাথে। অনেক কথার মাঝে তিনি বলে ফেলেন তার জীবনের কাহিনী। এই ভালোবাসা দিবসে ট্রাক চালক মনসুর ভাইয়ের কাছ থেকেই শুনে নেই তার ভালোবাসার গল্প।

 

ভালোবাসা কি তবে শুধু মানুষে মানুষেই হয়। যন্ত্রকেও তো ভালোবাসতে পারে কেউ কেউ। ব্যাপারটি হাস্যকর হলেও আমি মনসুর মিয়া, আমার বেডফোর্ড জে সিক্স ট্রাকটিকে নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসি। প্রায় ৩২ বছর ধরে একসাথে আছি আমরা। যদিও এই ভালোবাসায় অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। ঠিকমত গেয়ার চেঞ্জ করতে না পারার কারনে ওস্তাদের কষানো চড় খেয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে গালি ট্রাকটাকেই দিতাম। কবে স্টিয়ারিং হাতে পাব সেই আশায় দিন গুনতাম, হাতে পেলে কি যে ভালো লাগত। সেকি উত্তেজনা, অনেকটা প্রেমিকার সাথে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার মত।

 

a truck and a story of love

 

সেসব দিন অনেক আগেই পার হয়েছে । আমার বয়স এখন পঞ্চান্ন। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক বার সে অসুস্থ হয়ে গ্যারেজে পড়ে ছিল। সে একআজব যন্ত্রনা। কখন ঠিক হবে, কিভাবে ঠিক হবে এসব নিয়ে মিস্ত্রির সাথে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি কম হয়নি। সব কাজ হয়ে গেলে চক্কর দিতাম ফাকা রাস্তায়। কথোপকথন তখনই হত। এক্সিলারেটর আর ক্লাচ জানান দিত তার চিকিৎসা ঠিকমত হয়েছে কিনা।

সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি এই ট্রাক নিয়ে। রাস্তাগুলো হাতের রেখার মত মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।  কত রাত-বিরাতে অচেনা জায়গায় বসে থেকেছি মালামাল নিয়ে। তখন মোবাইল ছিলনা কিন্তু তাই বলে কাজ থেমে থাকতনা। একা একা এই দীর্ঘ রাতগুলোতে সিগারেট খাওয়া আর বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ থাকতনা। তখন মনের ভুলে দু-একটা কথা ট্রাকটাকেও বলে ফেলতাম। আমার হেল্পার আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে আর বলে, “ওস্তাদ আপনে তো শেষ”। আমিও হাসি তার কথা শুনে। হেল্পার আলম আমার সাথে আছে প্রায় বছর দশেক। সে আমাকে মামা ডাকে কিন্তু তার মায়ের সাথে আমার কোনদিন দেখা হয়নি। ট্রাকের কোন অযত্ন হলে আমার চেহারা যে বদলে যায় তা সে জানে।

সম্পর্ক, ভালোবাসা হচ্ছে গাছের মত। সবসময় যত্নে রাখতে হয়। আমার পরিবারের প্রতি আমার যতটুকু খেয়াল থাকে, ট্রাকের জন্য কোন অংশে কমতি থাকেনা। বউ মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করে বলে, “ট্রাকের সাথেই থাকেন, ওইটা আমার সতীন”। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে শুধরে নিয়ে ভাবেন, ট্রা্কের চাকা ঠিকমত না ঘুরলে সংসার চালাবেন কিভাবে।

চারিদিকে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। কত ফ্লাইওভার, বড় বড় ব্রীজ, নতুন নতুন সব রাস্তা হয়েছে। পরিচিত সব জায়গাগুলো কেমন বদলে গেছে । বয়স বাড়লে হাতের রেখা যেমন মুছে যেতে শুরু করে তেমন রাস্তাগুলোও অচেনা হতে শুরু করেছে। অনেক রকমের নতুন ডিজাইনের ট্রাক এখন চলে রাস্তায়। তার মাঝে আমার বেডফোর্ড একটু আলাদাই থাকে। আলাদা হলেও আমার মত আমার ট্রাকটিও বুড়ো হয়ে গেছে। সব জায়গায় চলতে দেয়না পুলিশ। তবু কস্ট করে চলতে হয়। নতুন ট্রাক আমার  কিনতে ইচ্ছে করেনা।

সামনে ভালোবাসা দিবস। শুনেছি এইদিন সবাই ভালোবাসার কথা বলে। কে কাকে কি বলে, কে জানে। তবে আমার ভালোবাসা আমার সাথেই থাকে। আমি আর আমার বেডফোর্ড ট্রাক, হয়ত আমৃত্যু একসাথেই থাকব।

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা রইল।

Back to top