জেনে নিন কোরবানির পশু পরিবহনে যে ভুলগুলো এড়িয়ে চলা উচিত

ঈদ-উল-আযহা ইসলামে একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, যা আত্মত্যাগ এবং ত্যাগের মহিমা বহন করে থাকে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরাঞ্চল পর্যন্ত কোরবানির পশু পরিবহনের এক বিশাল কার্যক্রম চলে। তবে এই মহৎ উদ্দেশ্য পূরণের সময় কিছু সাধারণ ভুল এবং অসতর্কতার কারণে পরিবহন ব্যবস্থায় নানা ধরনের অসুবিধা, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এমনকি গুরুতর আইনি জটিলতারও সৃষ্টি হতে পারে। তাই এই বিশেষ সময়ে পশু পরিবহনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সচেতনতা এবং সরকার নির্ধারিত সঠিক নিয়মাবলী অনুসরণ করা অপরিহার্য। কেননা, নিরাপদ ও সুষ্ঠু পশু পরিবহন নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব।

এই ব্লগে, আমরা কোরবানির পশু পরিবহনের সময় সচরাচর ঘটে যাওয়া ভুলগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব এবং সেই ভুলগুলো এড়িয়ে চলার জন্য কার্যকর ও ব্যবহারিক উপায়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ব্লগটির প্রধান লক্ষ্য হলো প্রতিটি কোরবানির পশু যেন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে  নিরাপদে ও সুস্থ অবস্থায় এবং এই পবিত্র উৎসবের আনন্দ যেন কোনো প্রাণীর কষ্টের কারণ না হয়ে উঠে।

১. অনুমোদনহীন পরিবহন ব্যবস্থা থেকে সাবধান

কোরবানির ঈদের সময় চাহিদা অনেক বেশি থাকায় দ্রুত এবং কম খরচে পশু পরিবহনের উদ্দেশ্যে অনেক সময় অনুমোদনহীন বা অনিবন্ধিত পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, কোনো প্রকার যথাযথ কাগজপত্র বা পারমিট ছাড়াই অসতর্কভাবে পশু পরিবহন করা হয়, যা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটি গুরুতর অপরাধ। এমন অননুমোদিত পরিবহন ব্যবস্থায় পশুর নিরাপত্তা ঝুঁকিও বহুগুণ বেড়ে যায়।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • নির্ধারিত পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করুন: পশু পরিবহনের জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা বেছে নিন। এসব গাড়ির ধারণক্ষমতা ও নিরাপত্তা মান নিশ্চিত থাকে।
  • ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা: সড়কে সবসময় ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা মেনে চলুন। তাদের নির্দেশনা মেনে চললে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হয় এবং পরিবহন যাত্রা অনেকটাই সহজ হয়।
  • ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার: ট্রাক লাগবে- এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন, যেখানে সকল ট্রাক ও ড্রাইভার নিবন্ধিত এবং যাচাইকৃত। এতে অনুমোদনহীন পরিবহন ব্যবহারের ঝুঁকি কমে।

 

২. অতিরিক্ত পশু বোঝাই এড়িয়ে চলুন

অতিরিক্ত লাভ বা সময় বাঁচানোর লোভে অনেক ব্যাপারী বা পরিবহনকারী একটি ট্রাকেই এর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক পশু বোঝাই করে থাকেন। যার ফলে পশুদের নড়াচড়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না এবং তারা একে অপরের চাপে গুরুতরভাবে আহত হতে পারে। অতিরিক্ত চাপ, অক্সিজেনের অভাব এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এমনকি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পশু মারাও যেতে পারে। 

সচেতনতা ও করণীয়:

  • ট্রাকের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী লোড করুন: প্রতিটি ট্রাকের একটি নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা থাকে। সেই ধারণক্ষমতা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সংখ্যক পশু তুলুন। ট্রাক লাগবে অ্যাপে ট্রাকের ধারণক্ষমতা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে, যা আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
  • পর্যাপ্ত জায়গা নিশ্চিত করুন: প্রতিটি পশুর জন্য ট্রাকে পর্যাপ্ত জায়গা নিশ্চিত করুন, যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে দাঁড়াতে, বসতে এবং সামান্য নড়াচড়া করতে পারে।
  • পশুর ধরন বুঝে ট্রাক নির্বাচন: গরুর আকার অনুযায়ী ট্রাকে পশুর সংখ্যা নির্ধারণ করুন। আকারে ছোট পশুর জন্য যে সংখ্যা প্রযোজ্য, বড় আকারের পশুর ক্ষেত্রে তা ভিন্ন হবে।

 

৩. দীর্ঘ যাত্রায় খাদ্য ও পানির সুব্যবস্থা রাখুন

দীর্ঘ পথযাত্রায় পশু পরিবহন করার সময় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা না রাখলে তাদের শরীরে মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এতে করে পশুর শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। অন্যদিকে, অসুস্থ বা দুর্বল পশুর বাজারে চাহিদা কমে যায়, যা বিক্রেতার জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • পর্যাপ্ত পানি ও সহজপাচ্য খাবার: যাত্রার আগে এবং পথে বিরতি নিয়ে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও হালকা খাবার (যেমন - তাজা ঘাস, খড়) সরবরাহ করুন।
  • পরিকল্পিত বিরতি: দীর্ঘ যাত্রার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিরতি নেওয়ার পরিকল্পনা করুন, যেখানে পশুদের বিশ্রাম এবং খাবার-পানির ব্যবস্থা করা যায়।
  • আর্দ্রতা বজায় রাখা: বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় পশুদের শরীরে পানির ছিটা দিয়ে বা ভেজা চট দিয়ে ঢেকে আর্দ্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করুন।

 

৪. ছায়া ও বাতাস চলাচলের অভাবের দিকে নজর দিন

গরমের দিনে বা সূর্যের প্রখর তাপে ছায়াহীন এবং বাতাস চলাচলের অসুবিধাযুক্ত পরিবহনে পশু রাখা হলে তারা অতিরিক্ত গরমে প্রচণ্ড কষ্ট পায়। এর ফলে হিট স্ট্রোক এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে, যা পশুর জীবন বিপন্ন করতে পারে। আবদ্ধ পরিবেশে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকলে পশুর মধ্যে দ্রুত শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • ছায়া দেয়ার ব্যবস্থা: ট্রাকে এমনভাবে ছাউনি বা আচ্ছাদন তৈরি করুন, যা পশুর উপর সরাসরি সূর্যের তাপ পড়া থেকে রক্ষা করে এবং পর্যাপ্ত ছায়ার ব্যবস্থা করে।
  • বায়ু চলাচল: ভালোভাবে বায়ু চলাচল নিশ্চিত হয় এমন পরিবহন ব্যবস্থা বেছে নিন। প্রয়োজনে ট্রাকে অতিরিক্ত ভেন্টিলেশন বা বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা রাখুন। 
  • দিনের তাপ এড়িয়ে চলুন: দিনের বেলায় যখন তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেই সময়গুলোতে যাত্রা এড়িয়ে চলুন। ভোরবেলা বা সন্ধ্যার পরে যাত্রা শুরু করলে পশুর কষ্ট অনেকটাই কমানো সম্ভব।

 

৫. পশুর প্রতি মানবিক আচরণ করুন

অনেক সময় পশুকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তাদের পায়ে বা গলায় শক্ত করে দড়ি বেঁধে টেনে আনা হয়, কিংবা নির্দয়ভাবে আঘাত করা হয়। এটি কেবল অমানবিকই নয়, বরং পশুর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাদের মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমন আচরণ পশুর মানসিক চাপ বাড়ায় এবং তাদের আতঙ্কিত করে তোলে।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • সহানুভূতিশীল হোন: পশুর প্রতি সর্বদা সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ করুন। মনে রাখবেন, তারাও জীবন্ত প্রাণী এবং কষ্ট অনুভব করে।
  • অভিজ্ঞ হ্যান্ডলার: পশুকে ট্রাকে তোলা-নামানোর জন্য অভিজ্ঞ হ্যান্ডলারের সাহায্য নিন। তারা পশুর শারীরিক গঠন ও আচরণ সম্পর্কে অভিজ্ঞ থাকেন এবং আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে কাজ করতে পারেন।
  • নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি: পশুকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নিরাপদ এবং মানবিক পদ্ধতি অবলম্বন করুন। প্রয়োজনে নরম দড়ি বা বেল্ট ব্যবহার করুন এবং পশুর গলায় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকুন।

 

৬. ট্রাফিক জ্যাম ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো

কোরবানির ঈদে সড়কে পশুবাহী গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এই সময়ে বেপরোয়া ড্রাইভিং, ট্রাফিক আইন ও নিয়মাবলী সঠিকভাবে না মানা এবং বিশেষত রাতের বেলায় অতিরিক্ত গতিতে বা পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়া গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 

সচেতনতা ও করণীয়:

  • অভিজ্ঞ ড্রাইভার: পশু পরিবহনের জন্য অভিজ্ঞ এবং দায়িত্বশীল ড্রাইভার নিয়োগ করুন, যাদের দীর্ঘ পথে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আছে এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে।
  • ট্রাফিক আইন মেনে চলুন: ড্রাইভার এবং হেলপারকে ট্রাফিক আইন ও সড়কের নিরাপত্তা বিধিমালা কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনা দিন।
  • দিনের আলোয় যাত্রা: রাতে ট্রাক চালাতে অসুবিধা হলে দিনের আলোয় যাত্রা করার চেষ্টা করুন। রাতের বেলায় স্বাভাবিকভাবেই দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। যদি রাতে যাত্রার পরিকল্পনা থাকে তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা এবং ধীর গতিতে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দিন।
  • অগ্রিম পরিকল্পনা: যানজটপূর্ণ রুটগুলো এড়িয়ে চলার জন্য অগ্রিম রুট পরিকল্পনা করুন। ট্রাক লাগবে অ্যাপে আপনি চাইলে দু’দিন আগেই ট্রাক বুক করতে পারবেন এবং ট্রাক বুকিংয়ের পর ড্রাইভারের সাথে সুষ্ঠুভাবে রুট প্ল্যান করতে পারবেন যা যানজট এড়াতে সাহায্য করতে পারে।

৭. সঠিক ট্রাক নির্বাচন এবং ডিজিটাল সহায়তা

পশুর ওজন ও প্রকারভেদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন ট্রাক নির্বাচন করলে তা পরিবহন প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। যেমন, অতিরিক্ত ছোট ট্রাকে বেশি পশু তোলা, বা কাভার্ড ভ্যান ব্যবহার করা যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • পশুর ওজন অনুযায়ী ট্রাকের সাইজ: কোরবানির পশুর ওজন এবং সংখ্যা অনুযায়ী ট্রাকের সাইজ নির্ধারণ করুন। ট্রাক লাগবে অ্যাপে পিকআপ ট্রাক, ১ টন ট্রাক, ২ টন ট্রাক, ৩ টন ট্রাক থেকে শুরু করে ১৫ টন ট্রাক বা তারও বেশি ধারণক্ষমতার ট্রাকের বিভিন্ন অপশন রয়েছে। টাটা পিকআপ, টয়োটা পিকআপ, ইসুজু পিকআপ, মাহিন্দ্রা বোলেরো পিকআপ এবং আশোক লেল্যান্ড ট্রাকের মতো বিভিন্ন ধরনের ট্রাক পাওয়া যায়।
  • দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার হিসাব: দূরত্বের উপর ভিত্তি করে ভাড়ার হিসাব মিলিয়ে দেখুন। ট্রাক লাগবে অ্যাপে অগ্রিম ভাড়ার একটি ধারণা পাওয়া যায়, যা বাজেট পরিকল্পনায় সহায়তা করে। দূরত্ব বেশি হলে একবারে বেশি মাল পাঠানো লাভজনক হতে পারে, সেজন্য অগ্রিম প্ল্যান করা জরুরি।
  • সঠিক লজিস্টিক কোম্পানি নির্বাচন: ট্রাক লাগবে- এর মতো নির্ভরযোগ্য লজিস্টিক কোম্পানি বেছে নিন, যারা পশু পরিবহনে অভিজ্ঞ এবং প্রয়োজনীয় সকল নিরাপত্তা মান বজায় রাখে।

৮. জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুতি 

অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য কোনো প্রস্তুতিই যথেষ্ট নয়। যেমন, পথে যদি ট্রাক নষ্ট হয়ে যায় বা পশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যা হয়, তবে পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

সচেতনতা ও করণীয়:

  • যোগাযোগ ব্যবস্থা: জরুরি সময়ে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় নাম্বারগুলো হাতের কাছে রাখুন।
  • বিকল্প ব্যবস্থা: বড় ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, তা ভেবে রাখুন। 
  • ছোটখাটো মেরামত: ছোটখাটো মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং একজন দক্ষ হেলপার যেন ট্রাকের সাথে থাকেন, তা নিশ্চিত করুন।

 

কোরবানির পশু পরিবহনে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পবিত্র উৎসবে পশুদের কোনো প্রকার কষ্ট না দিয়ে, সম্পূর্ণ নিরাপদে এবং সরকার নির্ধারিত সকল নিয়ম মেনে পরিবহন করা আমাদের সকলের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। 



Back to top