বলা হয়ে থাকে মানব সভ্যতার বিকাশ সাধনে চাকা একটি গুরুত্বপূর্ন আবিষ্কার। পণ্য পরিবহণ আগের থেকে সহজ হয়ে যাওয়ায় মানুষ দূরদুরান্তে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর সাহস পায়। ট্রাক নামের বাহনটিরও মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসায়িক পণ্য নির্দিস্ট স্থানে পৌছে দেওয়া। চাকা হচ্ছে ট্রাকের একটি অপরিহার্য অংশ আর টায়ার হচ্ছে চাকার উপরিভাগে রাবারের তৈরি বাইরের অংশ। মূলত টায়ারের কারনেই ট্রাক সব জায়গায় যেতে পারে। তাই এক কথায় বলা যায় – টায়ার ছাড়া ট্রাক আর জুতা বিহীন পা, একই কথা।
বাজারে বিভিন্ন ধরনের বা সাইজের টায়ার পাওয়া যায়। টায়ারের গায়ে বিভিন্ন ইনফরমেশন বড় করে লেখা থাকে যেমন, কত নম্বর টায়ার, সাইজ, লোড ইন্ডেক্স, প্রস্তুতকারকের নাম, কোন দেশে প্রস্তুত করা হয়েছে। টায়ার কেনার সময় এই ইনফরমেশন গুলো দেখে নেয়াটা জরুরি কারন, ভুল টায়ারের জন্য ট্রাক থেকে সঠিক পারফরমেন্স পাওয়া সম্ভব নয়।
যেহেতু টায়ার ট্রাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই ট্রাক যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে সার্ভিস দেয় সেজন্য টায়ারের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন, নাহলে নস্ট টায়ার অনাকাংখিত বিলম্বের কারন হতে পারে।
টায়ারের যত্নে কিছু নিয়ম মেনে চললে টায়ার দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব হয়। আপনার সুবিধার্থে এরকমই ৮টি টিপস নীচে উল্লেখ করা হলো –
১. টায়ার প্রেসার ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখুনঃ বর্তমানে দুই ধরনের টায়ার পাওয়া যায় বাজারে এর মধ্যে একটিতে টিউব থাকে এবং অন্যটিতে থাকেনা। ট্রাকের ক্ষেত্রে টিউবসহ টায়ারই বাংলাদেশে বেশী চলে। টিউবে থাকে বাতাস এবং এই বাতাসের পরিমান ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। পিছনে এবং সামনের টায়ারে বাতাসের প্রেসার দুই রকম হয়। যেমন- টাটা ইএক্স ২ ট্রাকের পিছনের চাকায় টায়ার প্রেসার ৯০ এবং পিছনের চাকায় ৮০ থাকতে হয়। টায়ার প্রেসার ঠিক না থাকলে যা হতে পারে-
২. টায়ার কোথাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিনা লক্ষ্য রাখুনঃ রাস্তায় চলতে গেলে অনেক কিছুর সংস্পর্শে আসে টায়ার। রাস্তায় ছড়ানো থাকতে পারে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর বস্তু যেমন- লোহার টুকরো, পেরেক, কাঁচ। এই জিনিষগুলো টায়ারের উপরিভাগে ক্ষত তৈরি করে। এছাড়াও অনেক সময় টায়ার প্রস্তুতকারকের নিকট থেকেই ত্রুটিযুক্ত হয় আসে। কিছুদিন চলার পর বুঝতে পারা যায়। এইক্ষেত্রে সময়মত সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে টায়ার বদলে নিতে পারবেন প্রস্তুতকারী কোম্পানি থেকে যদি তারা টায়ার কেনার সময় গ্যারান্টি দিয়ে থাকে ।
৩. টায়ারের উপরিভাগের পুরুত্ব ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখুনঃ টায়ারের যে অংশটুকু রাস্তার সাথে সংস্পর্শে থাকে এখানে সেই অংশটুকুকে উপরিভাগ হিসাবে বলা হচ্ছে। ইংরেজীতে বলা হয় “ট্রিড”। যেহেতু চাকা সর্বদা ঘূর্ণায়মান থাকে তাই রাস্তার সাথে ক্রমাগত ঘর্ষণের কারনে এটি ক্ষয় হতে থাকে এবং কোন এক পর্যায়ে টায়ার ফেটে গিয়ে মধ্যপথে ট্রাক বিকল হয়ে যেতে পারে। যুক্ত্ররাজ্যে সাড়ে তিন টন থেকে বেশী ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রাকের চাকার ট্রিড নূন্যতম ১.০০ মিলিমিটার থাকতে হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কোন আইন না থাকলেও আমাদের নিজেদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে এই ব্যাপারটি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
৪. মাত্রাতিরিক্ত ওজন বহন পরিত্যাগ করুনঃ একটি ট্রাক সর্বোচ্চ কতটুকু ওজন নিতে পারবে তা ট্রাকের বডি, চেসিস, ইঞ্জিনের সাথে টায়ারের উপরও নির্ভর করে। যেমন- ১ টন ০৭ ফিট একটি ট্রাকে সর্বোচ্চ ট্রাকের ওজনসহ ১১৭০ কেজির বেশী ওজন নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু অনেক ট্রাক মালিক মাত্রার থেকেও বেশী ওজন নিয়ে থা্কেন । এর ফলে ট্রাকের ইঞ্জিন এবং বডির পাশাপাশি টায়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইঞ্জিন এবং চেসিসের ক্ষয় তাৎক্ষনিক না বোঝা গেলেও, এক্ষেত্রে টায়ার দ্রুত বাতিল হয়ে যায়।
৫. চাকার এলাইনমেন্ট ঠিক রাখুনঃ ট্রাকের সাথে চাকা যুক্ত করার সময় চেসিসের সাথে চাকার এঙ্গেল ঠিক আছে কিনা খেয়াল রাখতে হয়। এই এঙ্গেল বা এলাইন্মেন্ট ঠিক না থাকলে টায়ারের যেকোন একটি পাশ বেশী ক্ষয় হতে থাকবে এবং টায়ার দ্রুত নস্ট হবে। এইক্ষেত্রে ট্রাক মালিক টায়ার রোটেশন করার মাধ্যমে ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার আরো কিছুদিন ব্যবহার করতে পারবেন।
৬. স্পীড ব্রেকারে সাবধানে পার হতে হবেঃ সড়কে যানবাহনের গতি কমানোর জন্য স্পিড ব্রেকার স্থাপন করা হয় এবং শহরের মধ্যেই তা বেশী দেখা যায়। ট্রাক যখন পণ্য নিয়ে স্পিড ব্রেকার পার হয় তখন টায়ারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। দ্রুতগতিতে যখন কোন ট্রাক ওজন নিয়ে পার হয় তখন টায়ার ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই স্পিড ব্রেকার সবসময় সাবধানে পার হওয়া উচিত।
৭. দক্ষ চালক নিয়োগ করুনঃ একটি ট্রাক ভালোভাবে চলবে কি চলবে না তা নির্ভর করে ট্রাক চালকের উপর। কোন রাস্তায় কত গতিতে চালালে টায়ার ক্ষয় কম হবে সে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হয়। চালক দক্ষ না হলে প্রথম ধাক্কাটি টায়ারের উপর দিয়েই যায়।
৮. ট্রাক প্রস্তুতকারকের নির্দেশনা মেনে চলুনঃ ট্রাক যখন ক্রয় করা হয় তখন ট্রাকের সাথে যে চাকা লাগানো থাকে সেই চাকাটিই সবসময় ব্যবহার করা উচিত কারন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভেবে চিন্তেই এই চাকা অফার করেছে। অনেক ট্রাক মালিক চাকা মডিফিকেশন করেন যাতে বেশী পণ্য নিতে পারেন। কিন্তু পারতপক্ষে তা করা উচিত নয় কারন এতে ইঞ্জিন এবং চেসিসের ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশের টায়ার মার্কেট অনেক বড় কারন অন্যন্য দেশের তুলনায় এদেশে পণ্য পরিবহন তুলনামূলকভাবে বেশী। দুটি সমুদ্রবন্দর থাকায় প্রচুর আমদানী-রপ্তানী হয়। আবার নিজস্ব পণ্য তো আছেই – আর এসব পরিবহণ হয় ট্রাকের মাধ্যমেই। বাংলাদেশে টায়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে GAZI TYRE এবং HUSEN TYRE অন্যতম। এছাড়া MEGHNA GROUP টায়ার উৎপাদন করলেও তা রপ্তানী হয়। দেশে বিক্রি হওয়া টায়ারের একটি বড় অংশ আমদানী করা হয়। যার মধ্যে MRF, CEAT, APOLLO, BIRLA অন্যতম। এছাড়া কিছু নন ব্র্যান্ডের চাইনীজ টায়ার পাওয়া যার দাম তুলনামূলকভাবে কম।
সময়ের সাথে প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন হওয়ার কারনে এখন সবকিছুই ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। ট্রাক মালিকগন এখন মোবাইলের মাধ্যমে তাদের ট্রাকের জন্য ট্রিপ খুঁজে নিতে পারছেন। আবার যাদের ট্রাক প্রয়োজন তাদেরকেও কস্ট করে ট্রাক স্ট্যান্ডে যেতে হচ্ছেনা, মোবাইলের মাধ্যমেই সব সম্ভব হচ্ছে। গুগল প্লেস্টোর থেকে ট্রাক লাগবে অ্যাপ ডাউনলোড করে এই সেবাটি পাওয়া এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে, বিশেষ করে যারা নতুন ব্যবসায় নামছেন তারা ট্রাক লাগবে অ্যাপ ব্যবহার করে ব্যবসায় লাভবান হতে পারেন।